বন্ধুরা, সরকারি অফিসে কাজ করতে গিয়ে বিরক্তি বা হতাশা হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন, তাই না? আমরা প্রায় সবাই জানি, জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জরুরি কাজে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো, অযথা কাগজপত্রের জটিলতা, আর পদে পদে হয়রানি – এসব যেন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও এর বাইরে নয়; অনেক সময় দেখেছি, একটা ছোট কাজের জন্য দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে, অথচ সমাধান পাওয়ার কোনো নাম নেই। মনে প্রশ্ন আসে, আধুনিক এই ডিজিটাল যুগেও কেন এমনটা হবে?

বর্তমানে দেশের জনপ্রশাসনে অনেক পরিবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে, নতুন নতুন আইন আর ডিজিটাল সেবার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কতটা তার সুফল পাচ্ছি? কেন আজও দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি আমাদের উন্নতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
কেনই বা আমরা যোগ্যতার চেয়ে দলীয়করণ বা অন্য কিছুর প্রাধান্য দেখছি? এসব প্রশ্ন আমার মনে প্রায়ই আসে, আর আমার বিশ্বাস, আপনাদের মনেও আসে। একটি দক্ষ ও জনমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য কোথায় আসল সমস্যাগুলো লুকিয়ে আছে, আর কীভাবে আমরা সবাই মিলে এর একটা স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে পারি, তা জানা খুবই জরুরি।আমরা স্বপ্ন দেখি এমন একটি প্রশাসনের, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার ন্যায্য অধিকার পাবে, যেখানে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা হবে মূল মন্ত্র। যেখানে প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করবে, জটিলতা বাড়াবে না। সম্প্রতি বিভিন্ন সংস্কার কমিশন এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করছে, নতুন নতুন প্রস্তাবনাও আসছে। কিন্তু এই প্রস্তাবনাগুলো কতটা কার্যকর হবে, আর কবে নাগাদ এর বাস্তব সুফল পাব, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন। এই লেখায় আমি আমার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও সাম্প্রতিক বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে সরকারি ব্যবস্থাপনার ভেতরের গল্পটা আপনাদের সামনে তুলে ধরব, আর দেখাবো কীভাবে এসব সমস্যা মোকাবিলা করে আমরা একটি জনমুখী এবং আধুনিক জনপ্রশাসন গড়তে পারি। চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক এই বিষয়ে!
প্রশাসনিক জটিলতা: সেবাপ্রত্যাশীদের নিত্যদিনের ভোগান্তি
আমরা যারা সরকারি অফিসে কাজ বা সেবা নিতে যাই, তারা সবাই কমবেশি একটা কথাই বলি – কাজটা কি আজ হবে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে, এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরাটা আমাদের অনেকেরই নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে জমির খারিজ, পাসপোর্ট নবায়ন, কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় কাজ, প্রায় সব ক্ষেত্রেই এক লম্বা দৌড়ঝাঁপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। আমার মনে আছে, একবার একটা সাধারণ প্রত্যয়নপত্রের জন্য আমি তিনদিন ধরে দৌড়েছি। প্রথমদিন গিয়ে শুনলাম, ‘আজ অফিসার নেই’, দ্বিতীয়দিন কাগজপত্রে ছোট একটা ভুল ধরার পর নতুন করে জমা দিতে বলল, আর তৃতীয়দিন গিয়ে দেখলাম, সব ঠিকঠাক থাকার পরেও ফাইলটা আটকে আছে কোনো এক অজানা কারণে। এই যে ছোট ছোট বিষয়গুলোতেও এত ভোগান্তি, এটা সত্যিই খুব বিরক্তিকর। মনে হয়, ডিজিটাল যুগে এসেও কেন আমরা এই এনালগ মানসিকতা আর অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছি?
এই ভোগান্তি কেবল সময় নষ্টই করে না, বরং পুরো ব্যবস্থার প্রতিই এক ধরনের অনাস্থা তৈরি করে। একটা সেবা পেতে গিয়ে যদি সাধারণ মানুষ বারবার হতাশ হয়, তাহলে তারা রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আস্থা হারায়, যা কোনো সুস্থ সমাজের জন্য ভালো নয়। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসাটা খুবই জরুরি।
অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ছড়াছড়ি
সরকারি দপ্তরে গেলেই দেখা যায়, একটি ছোট্ট কাজের জন্য একগাদা কাগজপত্রের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে অনেক কাগজই থাকে অপ্রয়োজনীয়, যা হয়তো আগে থেকেই তাদের কাছে আছে অথবা এমন কিছু, যা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সহজেই যাচাই করা সম্ভব। এই অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে গিয়েই সেবাপ্রত্যাশীদের অনেক সময় নষ্ট হয়, দৌড়াতে হয় বিভিন্ন জায়গায়। আমার তো মনে হয়, অনেক সময় ফাইল ভারী করার জন্যই এমনটা করা হয়, যাতে কাজটা আরও জটিল মনে হয়। এই যে কাগজপত্রের পাহাড় তৈরি করা হয়, এতে একদিকে যেমন সেবাপ্রত্যাশীর দুর্ভোগ বাড়ে, তেমনি অফিসের কর্মপরিবেশও বিঘ্নিত হয়। কেন আমরা এই পুরোনো পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে আছি, যখন প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কিছুই যাচাই করা সম্ভব?
একটি স্মার্ট ও গতিশীল প্রশাসনের জন্য অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাদ দিয়ে কেবল অত্যাবশ্যকীয় তথ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এতে মানুষের সময় বাঁচবে, অর্থ বাঁচবে, আর ভোগান্তিও কমবে।
দীর্ঘসূত্রিতা ও ফাইল আটকে থাকার সংস্কৃতি
যে কোনো সরকারি অফিসের একটি পরিচিত চিত্র হলো – ফাইল আটকে থাকা। একটি টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল যেতেই যেন কয়েক দিন লেগে যায়। এই ফাইল আটকে থাকার কারণে সাধারণ মানুষের কাজগুলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, একটি ছোট আবেদনের জন্য অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, অথচ কয়েক মিনিটের একটি স্বাক্ষর বা অনুমোদন পেলেই কাজটা শেষ হয়ে যায়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, অনেক সময় ফাইল আটকে থাকে শুধুমাত্র একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর বা অনুমোদনের অভাবে। এর পেছনের কারণগুলো অনেক সময় স্পষ্ট না হলেও, সাধারণ মানুষের ভোগান্তিটা কিন্তু স্পষ্ট। এই দীর্ঘসূত্রিতা কেবল কাজের গতিকেই শ্লথ করে না, বরং দুর্নীতির পথও খুলে দেয়। যারা দ্রুত কাজ চান, তাদের অনেক সময় অনৈতিক পথ বেছে নিতে প্ররোচিত করা হয়, যা পুরো ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই সমস্যা মোকাবিলায় শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা এবং সময়সীমা নির্ধারণ জরুরি।
ডিজিটাল যুগেও এনালগ পদ্ধতি: প্রযুক্তিগত সমন্বয়ের অভাব
আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি, যখন হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট। অথচ সরকারি অনেক দফতরে এখনো পুরোনো ফাইল-কাগজপত্রের স্তূপ, আর হাতের লেখা নথিপত্রের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। ভাবতে অবাক লাগে, তাই না?
যেখানে মুহূর্তের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব, সেখানে একটা ফাইল এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্কে পৌঁছাতেই দিনের পর দিন লেগে যায়। আমার তো মনে হয়, আমরা আসলে প্রযুক্তির সুবিধাগুলো পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারিনি। অনেক সময় দেখা যায়, নতুন কোনো ডিজিটাল সেবা চালু করা হলেও সেটার সঙ্গে পুরোনো ব্যবস্থার কোনো সমন্বয় নেই। ফলে মাঝেমধ্যে কাজ আরও জটিল হয়ে ওঠে। একটা জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে যদি দেখা যায়, অনলাইনে আবেদন করার পর আবার অফিসে গিয়ে কাগজের ফর্ম পূরণ করতে হচ্ছে, তখন পুরো ডিজিটাল ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। এই প্রযুক্তিগত সমন্বয়হীনতা সরকারি সেবার মানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি সমন্বিত ব্যবস্থা, যেখানে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হবে, এবং প্রতিটি সেবা একই প্লাটফর্মে সহজে পাওয়া যাবে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা
সত্যি বলতে কি, অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। হয়তো তারা পুরোনো পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, অথবা নতুন কিছু শেখার আগ্রহ কম। এর ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। আমি দেখেছি, অনেক দপ্তরে আধুনিক কম্পিউটার থাকলেও সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না, বা অনেক সময় সেগুলো পুরোনো ফাইলপত্রের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। অথচ এই প্রযুক্তিগুলোই পারে আমাদের কাজকে আরও দ্রুত ও নির্ভুল করতে। এই অনীহার কারণে সরকারের নেওয়া অনেক ডিজিটাল উদ্যোগই তার কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারছে না। নতুন প্রযুক্তি চালু করার পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করাটা খুব জরুরি। প্রযুক্তিকে কেবল একটি টুল হিসেবে না দেখে, কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতে হবে।
তথ্যভাণ্ডারের সমন্বয়হীনতা
আমাদের দেশে প্রতিটি সরকারি দপ্তরের নিজস্ব ডেটাবেস বা তথ্যভাণ্ডার আছে, কিন্তু সমস্যা হলো, এই ডেটাবেসগুলোর মধ্যে প্রায়শই কোনো সমন্বয় থাকে না। যেমন, আপনার জন্মনিবন্ধনের তথ্য এক দপ্তরে আছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য আরেক দপ্তরে, আর পাসপোর্ট অফিসের ডেটাবেস হয়তো আরও ভিন্ন। এর ফলে কী হয়?
একটা কাজ করতে গেলেই বারবার একই তথ্য নতুন করে দিতে হয়, যা খুবই বিরক্তিকর। আমি একবার পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়েছিলাম, যেখানে আমার জন্মনিবন্ধন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য আগেই ছিল, কিন্তু তারা আবার নতুন করে সবকিছু যাচাই করতে চাইল। এই সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক সময় ভুল তথ্যের আদান-প্রদানও ঘটে, যার ফলস্বরূপ সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি আরও বাড়ে। একটা কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার থাকলে যেখানে সব দপ্তরের তথ্য একত্রিত থাকবে এবং প্রয়োজনে সহজেই যাচাই করা যাবে, তাহলে এই সমস্যাগুলোর অনেকটাই সমাধান সম্ভব। এতে সময় বাঁচবে, খরচ কমবে, আর সেবার মানও উন্নত হবে।
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: আস্থার সংকট ও সমাধান
সরকারি দপ্তরের নাম শুনলেই অনেকের মনেই প্রথমে যে প্রশ্নটা আসে, তা হলো – কাজটা কি ঘুষ ছাড়া হবে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি আমাদের প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এটা শুধু অর্থিক দুর্নীতি নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, যোগ্যতার চেয়ে দলীয়করণকে প্রাধান্য দেওয়া – এসবও দুর্নীতিরই অংশ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একটা সময় ছিল যখন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ‘সুপারিশ’ না থাকার কারণে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়েকে পিছিয়ে পড়তে দেখেছি। এই বিষয়টা যে কতটা হতাশার, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। যখন একজন সাধারণ মানুষ দেখে যে, যোগ্যতার বদলে অনৈতিক প্রভাব বা অর্থের বিনিময়ে কাজ হচ্ছে, তখন তার মধ্যে পুরো ব্যবস্থার প্রতিই এক গভীর আস্থার সংকট তৈরি হয়। এই সংকট কেবল দেশের উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
অর্থনৈতিক দুর্নীতির গভীরে প্রবেশ
অর্থনৈতিক দুর্নীতি আমাদের প্রশাসনের একটি বড় ক্যান্সার। ছোট কাজ থেকে শুরু করে বড় বড় প্রকল্প পর্যন্ত, সবখানেই অর্থের লেনদেন বা ঘুষের অভিযোগ শোনা যায়। এই দুর্নীতি কেবল সাধারণ মানুষকে হয়রানিই করে না, বরং সরকারের তহবিলকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমি দেখেছি, একটা ছোট লাইসেন্স পেতেও অনেক সময় টেবিলের নিচ দিয়ে ‘কিছু’ দিতে হয়। এই যে একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এটা ভাঙা খুব কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। দুর্নীতি দমনে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করাটা জরুরি। এছাড়া, তাদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নও দুর্নীতির পথ সংকুচিত করতে পারে। একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারলে এই অর্থনৈতিক দুর্নীতি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির কালো ছায়া
দুর্নীতির আরেকটি বড় দিক হলো রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বজনপ্রীতি। অনেক সময় দেখা যায়, যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় বা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি, এমনকি কাজের বণ্টনের ক্ষেত্রেও এই ধরনের প্রভাব খাটানো হয়। আমার মনে আছে, আমার একজন বন্ধু খুবই মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার কারণে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পায়নি। এই ঘটনাটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। যখন যোগ্যতার মূল্য থাকে না, তখন মেধাবীরা হতাশ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, যা আমাদের দেশের জন্য এক বিশাল ক্ষতি। এই স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হলে একটি মেধাভিত্তিক, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ নিয়োগ ও পদোন্নতি পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কোনো দল বা ব্যক্তির প্রভাব নয়, কেবল যোগ্যতাকেই মানদণ্ড হিসেবে দেখতে হবে।
জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা: জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ
একটি শক্তিশালী ও জনমুখী প্রশাসনের মূল ভিত্তি হলো জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতা। অথচ আমাদের দেশে এই দুটো বিষয় নিয়েই অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো জনগণের মতামত ছাড়াই নেওয়া হচ্ছে, বা এমনভাবে নেওয়া হচ্ছে যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ থাকছে না। তথ্যের অবাধ প্রবাহ যেখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, সেখানে এখনো অনেক দপ্তরে তথ্য গোপন রাখার একটা প্রবণতা দেখা যায়। আমি দেখেছি, তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরও অনেক সময় তথ্য পেতে দীর্ঘসূত্রিতা হয়, বা কাঙ্ক্ষিত তথ্য পাওয়া যায় না। এই তথ্য গোপন করার সংস্কৃতি জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় বাধা। যদি জনগণ না জানে যে, সরকারের কোন কাজ কীভাবে হচ্ছে, কোথায় কত টাকা খরচ হচ্ছে, তাহলে তারা কীভাবে তাদের মতামত দেবে বা প্রশ্ন করবে?
একটি কার্যকর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণের কাছে তথ্য সহজলভ্য করতে হবে এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা
তথ্য অধিকার আইন আমাদের দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে সুরক্ষিত করে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের প্রয়োগে অনেক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, তথ্য চাইতে গেলে বিভিন্ন অজুহাতে তথ্য দেওয়া হয় না, বা দীর্ঘসূত্রিতা করা হয়। আমার একবার একটা নির্দিষ্ট প্রকল্পের বাজেট সম্পর্কে তথ্য জানার প্রয়োজন হয়েছিল, কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও আমি সঠিক তথ্যটি পাইনি। এমনটা হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি বিশ্বাস কমে যায়। এই আইনকে আরও কার্যকর করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে, জনগণকে তাদের তথ্য অধিকার সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করে তুলতে হবে।
নাগরিক সনদ এবং বাস্তবতার ফারাক
অনেক সরকারি অফিসে ‘নাগরিক সনদ’ বা ‘Citizen’s Charter’ ঝুলানো থাকে, যেখানে বিভিন্ন সেবার বিবরণ, সময়সীমা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উল্লেখ থাকে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ, কারণ এর মাধ্যমে সেবাপ্রত্যাশীরা জানতে পারে যে, তাদের কী কী সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, অনেক সময় এই সনদের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল থাকে না। আমি দেখেছি, সনদে লেখা আছে একটি কাজ তিন দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সেই কাজ শেষ হতে এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় লাগছে। এই ফারাকটা মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। নাগরিক সনদকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে না দেখে, এর প্রতিটি বাক্যকে বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য কঠোর তদারকি দরকার। এতে মানুষের আস্থা বাড়বে এবং সেবার মান উন্নত হবে।
কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
একটি আধুনিক ও গতিশীল জনপ্রশাসনের জন্য কর্মকর্তাদের দক্ষতা এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, একই কর্মকর্তা বছরের পর বছর ধরে একই পদ্ধতিতে কাজ করছেন, নতুন কৌশল বা প্রযুক্তির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছেন না। এর ফলে কাজের গতি কমে যায় এবং সেবার মানও ব্যাহত হয়। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, অনেক কর্মীর মধ্যে দক্ষতা বাড়াতে বা নতুন কিছু শিখতে এক ধরনের অনীহা কাজ করে। অথচ আধুনিক বিশ্বে প্রতিনিয়ত কাজের ধরন বদলাচ্ছে, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে আমাদের কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং আপডেটেড জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের দক্ষতা বাড়লেই কাজের গুণগত মান বাড়ে, আর এতে সাধারণ মানুষের উপকার হয়।
নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাব
আমাদের প্রশাসনের অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাব দেখা যায়। নতুন প্রযুক্তি বা আইনের পরিবর্তন এলেও, সে অনুযায়ী কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। ফলে তারা পুরোনো পদ্ধতিতেই কাজ করে যান। আমি দেখেছি, অনেক কর্মীর হয়তো নতুন সফটওয়্যার ব্যবহারের দক্ষতা নেই, ফলে তাদের কাজ করতে বেশি সময় লাগে, বা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই প্রশিক্ষণের অভাব সরাসরি সেবার মানকে প্রভাবিত করে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা পালন না করে, বাস্তবভিত্তিক এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া উচিত। এতে কর্মীরা তাদের কাজের ক্ষেত্রে আরও আত্মবিশ্বাসী হবেন এবং আরও ভালোভাবে সেবা দিতে পারবেন।
কর্মপরিবেশ ও অনুপ্রেরণার গুরুত্ব

শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, কর্মকর্তাদের একটি ভালো কর্মপরিবেশ এবং কাজের প্রতি অনুপ্রেরণাও জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, কর্মপরিবেশ ভালো না থাকলে বা কাজের সঠিক স্বীকৃতি না থাকলে কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েন। আমি দেখেছি, ভালো কাজের জন্য প্রশংসা বা স্বীকৃতি পেলে কর্মীরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হন। একটি ইতিবাচক কর্মপরিবেশ কর্মীদের মধ্যে কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে এবং তাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা দিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করে। এছাড়া, কাজের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক প্রভাবের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হলে কর্মীরা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হন। একটি আনন্দময় ও অনুপ্রেরণামূলক কর্মপরিবেশ উন্নত সেবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দীর্ঘসূত্রিতা ও ফাইল আটকে থাকা: কাজের গতিশীলতা বাড়াতে কী করণীয়?
সরকারি অফিসে গিয়ে ফাইল আটকে থাকার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই আছে। একটা সাধারণ কাজের ফাইল মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন টেবিলে ঘুরছে, অথচ কোনো সমাধান নেই। এই দীর্ঘসূত্রিতা কেবল সাধারণ মানুষের মূল্যবান সময়ই নষ্ট করে না, বরং তাদের মনে একরাশ হতাশা আর বিরক্তি তৈরি করে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, অনেক সময় দেখা যায় একটি ছোট ফাইল আটকে থাকে শুধুমাত্র একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর বা অনুমোদনের অভাবে, অথচ এইটুকু কাজ শেষ হতে এত সময় লাগার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে না। এই সমস্যাটি আমাদের প্রশাসনের একটি বড় দুর্বলতা, যা কাজের গতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। কেন এই ফাইলগুলো আটকে থাকে, আর কীভাবে আমরা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, তা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবা উচিত।
ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেমের কার্যকারিতা
ফাইল আটকে থাকার সমস্যা সমাধানের জন্য একটি কার্যকর ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা খুবই জরুরি। এর মাধ্যমে প্রতিটি ফাইল কোন কর্মকর্তার কাছে আছে, কতদিন ধরে আছে, এবং পরবর্তী ধাপ কী – তা সহজেই জানা যাবে। আমার মনে হয়, এমন একটি ডিজিটাল সিস্টেম থাকলে শুধু ফাইল আটকে থাকা কমবে না, বরং কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতাও বাড়বে। যখন একজন কর্মকর্তা জানবেন যে, তার কাছে থাকা ফাইলটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, তখন তিনি দ্রুত কাজ শেষ করতে আগ্রহী হবেন। এতে করে শুধু স্বচ্ছতাই বাড়বে না, বরং কাজের গতিশীলতাও অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে কিছু দপ্তরে এমন সিস্টেম চালু থাকলেও, সেগুলোর ব্যাপকতা এবং কার্যকারিতা আরও বাড়াতে হবে।
কাজের সময়সীমা নির্ধারণ ও মনিটরিং
প্রতিটি কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং সেই সময়সীমার মধ্যে কাজ সম্পন্ন হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিত মনিটরিং করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি একটি পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়া সাত দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকে, তাহলে সাত দিনের মধ্যেই সেটি সম্পন্ন হচ্ছে কিনা, তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমার দেখেছি, অনেক সময় সময়সীমা থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয় না। ফলে কর্মকর্তারা নির্দ্বিধায় কাজ ফেলে রাখেন। এই মনিটরিং ব্যবস্থা শুধু উপর মহল থেকে নয়, বরং অভ্যন্তরীণভাবেও জোরদার করতে হবে। এছাড়া, সময়মতো কাজ শেষ না হলে কেন হয়নি, তার কারণ বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে করে কাজের প্রতি কর্মকর্তাদের দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং দীর্ঘসূত্রিতা কমবে।
নাগরিক সনদ ও সেবার মান: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক
আপনারা অনেকেই হয়তো সরকারি অফিসের দেয়ালে ‘নাগরিক সনদ’ দেখেছেন। সেখানে লেখা থাকে কোন সেবা কত দিনে পাওয়া যাবে, কী কী কাগজপত্র লাগবে ইত্যাদি। এই সনদগুলো দেখে আমাদের মনে এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয় যে, এবার হয়তো আর ভোগান্তি হবে না, কাজটা দ্রুতই হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেশিরভাগ সময়ই এই প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে একটা বিশাল ফারাক থেকে যায়। কাগজে-কলমে যা লেখা থাকে, বাস্তবে তার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমি দেখেছি, একটি সনদে হয়তো লেখা আছে যে, অমুক কাজ তিন দিনের মধ্যে হবে, কিন্তু বাস্তবে সেই কাজ শেষ হতে কখনো কখনো এক সপ্তাহ বা তারও বেশি লেগে যায়। এই যে একটা অসংগতি, এটা মানুষের মধ্যে আস্থা নষ্ট করে এবং পুরো ব্যবস্থার প্রতিই এক ধরনের বিরক্তি তৈরি করে।
| সেবার ধরন | নাগরিক সনদে উল্লেখ্য সময় | বাস্তবে লাগা সম্ভাব্য সময় | মন্তব্য |
|---|---|---|---|
| জন্মনিবন্ধন | ৭ কর্মদিবস | ১০-১৫ কর্মদিবস | অনেক সময় অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হয় |
| পাসপোর্ট নবায়ন | ১০ কর্মদিবস (সাধারণ) | ১৫-২০ কর্মদিবস | পুলিশ ভেরিফিকেশনে বিলম্ব হয় |
| জমির খারিজ | ২৮ কর্মদিবস | ৫০-৬০ কর্মদিবস | ভূমি অফিসের প্রক্রিয়াগত জটিলতা |
| ট্রেড লাইসেন্স | ৩ কর্মদিবস | ৫-৭ কর্মদিবস | স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে দেরি হয় |
সেবার মানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
একটি ভালো সেবার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ, আজ আপনি যে মানের সেবা পেলেন, কালও যেন একই মানের সেবা পান। কিন্তু আমাদের সরকারি অনেক দপ্তরে এই ধারাবাহিকতার অভাব দেখা যায়। আমি দেখেছি, একই কাজ একেক সময় একেকভাবে হয়, বা একেক কর্মকর্তার কাছে গেলে একেক রকম অভিজ্ঞতা হয়। এই ধারাবাহিকতার অভাব সেবার মানকে খারাপ করে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। সেবার মানের একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড তৈরি করা এবং সেই মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিটি দপ্তরে সেবা প্রদান করাটা জরুরি। এছাড়া, সেবার মান নিয়ে নিয়মিত জরিপ করা এবং প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এতে সেবার মান উন্নত হবে এবং মানুষের আস্থা বাড়বে।
অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সহজীকরণ
যখন কোনো সেবাপ্রত্যাশী তার কাঙ্ক্ষিত সেবা পায় না বা ভোগান্তির শিকার হয়, তখন তার অভিযোগ জানানোর একটি সহজ এবং কার্যকর প্রক্রিয়া থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়াটিই অনেক সময় জটিল থাকে, বা অভিযোগ জানালেও তার কোনো সুরাহা হয় না। আমার মনে আছে, একবার আমি একটা সরকারি সেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে অভিযোগ জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কোথায় অভিযোগ জানাব, কীভাবে জানাব – এটাই বুঝে উঠতে পারিনি। এই যে অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় জটিলতা, এটা মানুষকে আরও হতাশ করে তোলে। অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়াটি সহজ করতে হবে, এবং প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করে দ্রুত সমাধান করতে হবে। এতে করে সেবাপ্রত্যাশীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতন হবেন এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা বাড়বে।
글을마চি며
সরকারি সেবা পেতে গিয়ে আমাদের যে নিত্যদিনের ভোগান্তি, তা কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি সামগ্রিক চিত্র। দিনের পর দিন একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে আমরা ক্লান্ত, হতাশ। তবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসাটা অসম্ভব নয়। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর সচেতনতাই পারে এই ব্যবস্থাকে আরও জনবান্ধব করে তুলতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, প্রতিটি ছোট অভিযোগ, প্রতিটি মতামতই পরিবর্তনের বীজ বপন করে। তাই আসুন, আমরা আমাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই এবং একটি উন্নত ও স্বচ্ছ প্রশাসনের জন্য সোচ্চার থাকি। মনে রাখবেন, আপনার একার অভিজ্ঞতা হাজারো মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে, যা হয়তো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনবে।
জেনে রাখুন কিছু দরকারী তথ্য
১. সরকারি সেবা নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনলাইন পোর্টাল বা ওয়েবসাইটের তথ্যগুলো ভালোভাবে দেখে নিন। অনেক কাজ এখন অনলাইনেই সেরে ফেলা যায়, যা আপনার সময় বাঁচাবে।
২. নাগরিক সনদ (Citizen’s Charter) সম্পর্কে অবগত থাকুন। প্রতিটি দপ্তরের বাইরে এটি টানানো থাকে, যেখানে সেবার ধরণ, সময়সীমা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উল্লেখ করা থাকে। আপনার অধিকার সম্পর্কে জানলে ভোগান্তি কমবে।
৩. যেকোনো কাজের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং রশিদ সাবধানে সংরক্ষণ করুন। ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা দেখা দিলে এগুলো প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে।
৪. একবার আবেদন করার পর নিয়মিত আপনার ফাইল বা আবেদনের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ নিন। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে সম্মানজনকভাবে যোগাযোগ করুন।
৫. যদি দেখেন আপনার কাজ অকারণে আটকে আছে বা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানোর চেষ্টা করুন। তথ্য অধিকার আইনের ব্যবহারও জানতে পারেন।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এক নজরে
আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা বিদ্যমান, যা সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তির প্রধান কারণ। অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ছড়াছড়ি, দীর্ঘসূত্রিতা, ফাইল আটকে রাখার সংস্কৃতি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির অপূর্ণ ব্যবহার এখনো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এছাড়াও, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি পুরো ব্যবস্থার প্রতিই জনগণের আস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এই সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং একটি ইতিবাচক কর্মপরিবেশও সেবার মান উন্নয়নে অত্যন্ত জরুরি। একটি আধুনিক, গতিশীল এবং জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে হলে এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া অত্যাবশ্যক।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ) 📖
প্র: জনপ্রশাসনে আমরা সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি কোন সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হই?
উ: বন্ধুরা, সরকারি অফিসে গিয়ে যে বিরক্তি বা হতাশা আমাদের হয়, সেটা তো আর নতুন কিছু নয়, তাই না? আমার নিজের অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি, জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে জমির কাগজপত্র, অথবা ছোটখাটো সরকারি সুবিধা পেতে গিয়ে কত ভোগান্তি পোহাতে হয়। আসলে জনপ্রশাসনের মূল সমস্যাগুলো এখন আর লুকানো নেই, এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে দুর্নীতি। পদে পদে ঘুষ ছাড়া যেন কোনো কাজই হয় না। একটা সামান্য ফাইল সরাতে গেলেও পিয়ন থেকে শুরু করে উপরের মহলের অনেকেই বাড়তি কিছু চান, আর এটা দিতে রাজি না হলে দিনের পর দিন ঘোরানো হয়। এই যে কিছুদিন আগে আমার এক আত্মীয় একটা জরুরি কাজের জন্য সরকারি অফিসে গেলেন, তাকে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে এমন নাজেহাল করা হলো যে শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তিনি টাকা দিয়েই কাজটা করালেন। ভাবুন তো, এটা কতটা দুঃখজনক!
দ্বিতীয়ত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর দীর্ঘসূত্রিতা। একটা আবেদন জমা দিলে সেটা কোন টেবিলে পড়ে আছে, কবে নড়বে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কাগজের পাহাড়ে চাপা পড়ে আমাদের জরুরি কাজগুলোও ধীরগতিতে চলে। কোনো উদ্যোগ নিলেই যেন অসংখ্য ধাপ পেরোতে হয়, যার অনেকগুলোই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। মনে আছে, আমার এক বন্ধুর একটা ব্যবসায়িক লাইসেন্সের জন্য সে এক মাস ধরে ছুটোছুটি করেছে, অথচ কাজটা কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এই যে সময়ের অপচয়, এটা আমাদের অর্থনীতির জন্যও কতটা ক্ষতিকর!
তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। আমরা জানি না, আমাদের ফাইলটা কোথায় আছে, কে এর দায়িত্বপ্রাপ্ত, বা কেন কাজটা আটকে আছে। তথ্য জানার অধিকার থাকলেও অনেক সময় তথ্য পেতে হয়রানি করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের আচরণও অনেক সময় জনমুখী হয় না; মনে হয় তারা আমাদের সেবক নন, বরং শাসক!
এই মানসিকতা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। তাদের কাছে গেলে মনে হয় যেন কোনো অনুগ্রহ চাইতে গেছি, অথচ এটা আমাদের ন্যায্য অধিকার। চতুর্থত, রাজনৈতিক প্রভাব। অনেক সময় যোগ্যতার চেয়ে দলীয়করণ বা স্বজনপ্রীতিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, যা মেধা ও সততাকে নিরুৎসাহিত করে। এই সবগুলো মিলিয়েই আমাদের জনপ্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, যা থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি।
প্র: বর্তমান সরকার কি এসব সমস্যা সমাধানে কোনো নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে? ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বা অন্য কোনো উদ্যোগ কি আসলেই সুফল বয়ে আনছে?
উ: হ্যাঁ, বন্ধুরা! এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বর্তমান সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে, এবং এর মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশনটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ আর সাম্প্রতিক খবরাখবর বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরিত করার লক্ষ্য নিয়েছে। এর মূল ভিত্তি হলো স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজ গড়ে তোলা।এই লক্ষ্যে, সরকারি সেবাগুলোকে ডিজিটাল করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে। যেমন, ‘এটুআই’ (Aspire to Innovate) প্রকল্প এর আওতায় অনেক সরকারি সেবা এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। জন্মনিবন্ধন, জমির খাজনা পরিশোধ, সরকারি ফর্ম পূরণ – এগুলোর অনেক কিছুই এখন ঘরে বসেই করা সম্ভব হচ্ছে, যা আমার মতো অনেকের ভোগান্তি অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আমার মনে আছে, কয়েক বছর আগেও জন্মনিবন্ধনের জন্য সরকারি অফিসে গেলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। এখন মোবাইলের মাধ্যমেও অনেক তথ্য যাচাই করা যায়, যদিও পুরোপুরি ঝামেলামুক্ত এখনও হয়নি। এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করছে।এছাড়াও, সম্প্রতি একটি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, যাদের মূল কাজ হলো প্রশাসনে চিহ্নিত সমস্যাগুলো পর্যালোচনা করে কার্যকর সুপারিশ পেশ করা। এই কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনার ওপর জোর দিচ্ছে। যদিও এই ধরনের সংস্কার রাতারাতি ফল দেয় না, তবে এই আলোচনা এবং উদ্যোগগুলো একটি সুস্থ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আমি মনে করি, এই পদক্ষেপগুলো যদি আন্তরিকতা ও সততার সাথে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর সুফল পাবো। তবে, এটা স্বীকার করতেই হবে যে পথটা এখনো অনেক দীর্ঘ এবং চ্যালেঞ্জিং।
প্র: একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা কীভাবে জনপ্রশাসনকে আরও জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক করতে সাহায্য করতে পারি?
উ: একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই জনপ্রশাসনকে জনমুখী এবং জবাবদিহিমূলক করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বন্ধুরা! শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, আমাদের নিজেদেরও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি যেমনটা সবসময় বলি, পরিবর্তনটা শুরু হয় আমাদের নিজেদের থেকেই।প্রথমত, আমাদের তথ্য জানার অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং সেই অধিকার প্রয়োগ করতে শিখতে হবে। যখন কোনো সরকারি সেবা পেতে গিয়ে দেরি হবে বা কোনো অস্বচ্ছতা দেখবো, তখন নির্দ্বিধায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাইতে হবে। আর যদি তাতেও কাজ না হয়, তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্যান্য অভিযোগ কেন্দ্রে অভিযোগ জানাতে দ্বিধা করা উচিত নয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রথমদিকে হয়তো অনেকে ভয় পায়, কিন্তু সম্মিলিতভাবে যদি আমরা তথ্য চাই এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি, তাহলে সেটা একটা বড় প্রভাব ফেলে।দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল সেবাগুলো ব্যবহার করতে শিখুন এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করুন। যখন সরকার ডিজিটাল সেবা দিচ্ছে, তখন সেগুলো ব্যবহার করে আমরা যেমন নিজেদের সময় ও শ্রম বাঁচাতে পারবো, তেমনই অফলাইনে অপ্রয়োজনীয় ভিড় কমিয়ে সেবার মান উন্নয়নে সাহায্য করতে পারবো। ই-সেবা পোর্টাল, অনলাইন আবেদন, এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং সেগুলো ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে হবে। এতে করে কাগজে কলমের ঝক্কি অনেকটাই কমে আসে এবং কাজের গতি বাড়ে।তৃতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন আলোচনা, গণশুনানি বা নাগরিক ফোরামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। আপনার এলাকার জনপ্রশাসনের সমস্যাগুলো তুলে ধরুন, গঠনমূলক সমালোচনা করুন এবং সমাধানের জন্য আপনার মতামত দিন। এই ধরনের নাগরিক অংশগ্রহণ প্রশাসনের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করে, যা তাদের আরও সতর্ক ও জনমুখী হতে বাধ্য করে। আমি নিজেও দেখেছি, যখন এলাকার মানুষ একত্রিত হয়ে কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলেছে, তখন প্রশাসন অনেক বেশি দ্রুততার সাথে পদক্ষেপ নিয়েছে।চতুর্থত, নৈতিকতার প্রশ্নে নিজেদেরও আপোসহীন হতে হবে। আমরা যদি ঘুষ না দেই বা অন্যায্য সুবিধা না চাই, তাহলে দুর্নীতির পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে। ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের প্রত্যেকের সততা ও নৈতিকতাই সবচেয়ে বড় শক্তি। মনে রাখবেন, ক্ষমতা যতই হোক, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একদিন নিশ্চয়ই এমন একটি জনপ্রশাসন পাবো, যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার ন্যায্য অধিকার পাবে এবং সেবা পেতে কোনো ভোগান্তি পোহাতে হবে না।






